কালাজ্বর নিরাময়ের উপায়

কালাজ্বর 

কালা জ্বর ভিসারাল লেশমানিয়াসিস বা ডামডাম ফিবার নামে পরিচিতি একটি রোগ।এটি একটি পরজীবী ঘটিত দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণঘাতী রোগ।লেইসম্যানিয়া ডনোভানী নামক একপ্রকার প্রোটোজোয়া পরজীবীর সংক্রমনের মাধ্যমে ছড়ায়। কালা জ্বর বেলে মাছির কামড়ের সাহায্যে বিস্তার লাভ করে থাকে। 

এই রোগ প্রথমে মানুষের রক্তের ম্যাক্রোফেই দ্বারা বাহিত হয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে লিভার অস্থিমজ্জা ও প্লীহা আক্রান্ত করে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে। ম্যালেরিয়ার পরে এটি পরজীবী ঘটিত রোগ গুলোর মধ্যে সবচাইতে প্রাণঘাতী একটি রোগ। এই রোগের চিকিৎসা সময়মতো সঠিকভাবে না করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে

কালাজ্বর হওয়ার কারণ

গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলির প্রত্যন্ত অঞ্চলে কালা জ্বর রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই রোগের প্রকোপ বেশি।কালা জ্বর সাধারণত বেলে মাছির কামড়ে ছড়ায়। বেলে মাছি সাধারণত ঘর এবং ঘরের আশেপাশের মেঝে, দেয়াল, কাঠের আসবাবপত্রের ফাটল, ভাঙ্গা ইট পাথরের নিচে এবং ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে।


এরা সন্ধ্যা হলে এইসব জায়গা থেকে বের হয়ে ভোর পর্যন্ত সময়ে মানুষ,পশু,পাখিকে কামড়িয়ে থাকে। এই রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে দুই মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কেবলমাত্র স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছি এ রোগ ছড়ায়। স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছি এদের ডিমের পরিপক্কতার জন্য পশু,পাখি এবং মানুষের রক্ত গ্রহণ করে থাকে।

স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছি কামড়ানো এমন পশু পাখির মাংস খাওয়ার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে থাকে। এছাড়াও যে সকল এলাকায় কালাজ্বর আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি অথবা নোংরা বস্তি এলাকা এইসব জায়গায় যাওয়ার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের কালাজ্বর বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নিয়মিত কর্মসূচি নেই।

কোন কোন এলাকায় ব্যাপক আকারে কালাজ্বর দেখা দিলে সেখানে কীটনাশক ছিটানো হয়। আবার কিছু কিছু এলাকায় কীটনাশক না ছিটিয়ে মশারি ব্যবহারের মাধ্যমে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। অবশ্য এই পদ্ধতিতে  সন্তুষ্টজনক ফলও পাওয়া গেছে। 

এই রোগের মূল জীবাণু প্রোটোজোয়া শরীরে প্রবেশের পর রোগ প্রতিরোধক কোষগুলোকে প্রভাবিত করে। এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রোটোজোয়া জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করে, এর ফলে শরীরে ফুটে ওঠে বিভিন্ন লক্ষণ।

কালা জ্বরের লক্ষণসমূহ

কালাজ্বরের লক্ষণ কিছুটা ম্যালেরিয়ার মত। কালা জ্বর প্রথম অবস্থায় অল্প থাকে আবার কোন কোন সময় অনেক বেশি জ্বর এবং সাথে কাঁপুনি থাকতে পারে। প্রথমে জ্বর আসার পর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যেতে পারে কিন্তু কিছুদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর পুনরায় জ্বর আসে। এই সময় কিছুদিন অন্তর অন্তর জ্বর আসার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।


এই দীর্ঘ সময়ের জ্বরের কারণে রোগী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। গায়ের রং কিছুটা কালো হয়ে যায়। এই সময় রোগীর পেটের বাম দিকে প্লীহা এবং ডান দিকের লিভার বাড়তে শুরু করে। এছাড়াও রোগীর শরীর দুর্বল হওয়ার কারণে মাথা ঘোরা ও শরীরে মৃদু কাপুনি দেখা দিতে পারে। এই সময় রোগীর প্রচন্ড জ্বর থাকা সত্ত্বেও খাবার খাওয়াতে অরুচি ভাব খুব কম দেখা যায়।

রোগী অনেক বেশি খেতে পারে অথবা খাবার খাওয়া স্বাভাবিক থাকে। কালা জ্বর শরীরে সংক্রমিত হওয়ার দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যেই শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে। যকৃতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সপ্তাহ বা মাস ধরে জ্বর, খিদা কমে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক, পাতলা এবং খসখসে হয়ে যাওয়া।

শরীরের চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়, রাতে অতিরিক্ত শরীর থেকে ঘাম হয় অথবা শরীর ফুলে যায়, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা,ছুলি, ফুসকুড়ি ইত্যাদি দেখা যায়। এছাড়াও কালা জ্বরের গুরুতর হলে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, অতিরিক্ত ওজন কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, শরীরের একাধিক অঙ্গের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দেশের শক্তি হারানো এইসব লক্ষণ দেখা দেয়।

শিশুদের ক্ষেত্রেও ক্ষুধামন্দা, দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, শিশু অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে যাওয়া।সময় ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশু একদম নিস্তেজ হয়ে যায় এবং শরীর লালচে ভাব ধারণ করে। এই রোগের সংক্রমণ বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশগত অবস্থা এবং মানুষের জীবন যাপনের ওপর নির্ভর করে। কালা জ্বরে সংক্রমিত হলে ৯০% পর্যন্ত মৃত্যু ঝুকি থাকে। 

কালাজরে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে যাদের

কালা জ্বর সাধারণত বেলে মাছির কামড়ে ছড়ায়। বেলে মাছি সাধারণত ঘর এবং ঘরের আশেপাশের  মেঝে, দেয়াল, কাঠের আসবাবপত্রের ফাটল, ভাঙ্গা ইট পাথরের নিচে এবং ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে।এরা সন্ধ্যা হলে এইসব জায়গা থেকে বের হয়ে ভোর পর্যন্ত সময়ে মানুষ,পশু, পাখিকে কামড়িয়ে থাকে।

স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছি এদের ডিমের পরিপক্কতার জন্য পশু,পাখি এবং মানুষের রক্ত গ্রহণ করে থাকে।স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছি কামড়ানো এমন পশু পাখির মাংস খাওয়ার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে থাকে। এছাড়াও যে সকল এলাকায় কালাজ্বর আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি অথবা নোংরা বস্তি এলাকা এইসব জায়গায় যাওয়ার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে থাকে। 

কালা জ্বরে  আক্রান্ত হয় বেশিরভাগ যারা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এমন মানুষ। বিশেষ করে যারা আয়রন, ভিটামিন এবং দস্তা এর অভাবে ভুগছেন। এসব লোকেদের কালাজ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়াও ৫ থেকে ১০ বছরের শিশুদের কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবথেকে বেশি। 

কিছু আদ্র এবং উষ্ণ এলাকাসহ যারা বনাঞ্চল বা বুঝতে টাইপের এলাকায় বসবাস করে, এমন জায়গায় বসবাসরত মানুষ এবং শিশুদের কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। যারা এইডস রোগে আক্রান্ত সেসব রোগীদেরও কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। 

কালাজ্বর নির্ণয় করার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের নিকটস্থ হতে হবে। জ্বরের লক্ষণ দেখে ম্যালেরিয়া নাশক অথবা অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সেবনেও কোন কাজ না হলে, এইটা কালা জ্বর হতে পারে। 

রোগ নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা,প্লীহা অথবা অস্থিমজ্জা থেকে নমুনা নিয়ে শরীরে কালা জ্বরের উপস্থিতি আছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষা করা হতে পারে। আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে রেপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট এর মাধ্যমে সহজেই কালাজ্বর রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

কালাজ্বরের চিকিৎসা

কালা জ্বর একটি মারাত্মক রোগ। সঠিক সময়ে এই রোগের চিকিৎসা না হলে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এমনকি চিকিৎসা নেওয়ার পরও শতকরা পাঁচজন রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে। কালা জ্বরের কোন প্রতিষেধক নেই। কালা জ্বর হয়েছে সন্দেহ হলেই প্রথম অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ শনাক্ত করার পর চিকিৎসকের পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হয়।

কালা জ্বর লিইসম্যানিয়াসিস রোগের একটি ধরন যা লিইস ম্যানিয়া ডনোভ্যানি দ্বারা হয়ে থাকে। বর্তমানে এ রোগের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ক্যাপসুল বাংলাদেশের সবথেকে বেশি ব্যবহার হচ্ছে এবং এটা সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কালাজ্বর একটি নিরাময় যোগ্য রোগ।

এই রোগটি শনাক্ত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে কালা জ্বর থেকে নিশ্চিত মুক্তি মিলবে। কাজেই শরীরের কালা জ্বর হয়েছে এমন ধরনের লক্ষণগুলো দেখলে খুবই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

কালাজ্বর নিরাময়ে করণীয় 

বেলে মাছি নিধনের জন্য ডিডিটি স্প্রে করার মত এলাকায় ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ করা। বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড়, নোংরা স্থান, ড্রেন, গরুর ঘর অথবা মাটির ঘরের দেয়ালের ফাঁকে নির্দিষ্ট সময় পর পর জীবাণুনাশক স্প্রে করার মাধ্যমে এই রোগ থেকে আমরা নিজেদেরকে নিরাপদে রাখতে পারি।

বেলে মাছি যেন বংশবৃদ্ধি না করতে পারে সেজন্য মাটির মেঝে বা দেয়াল ফাটল হীন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মানুষের থাকার ঘর গোয়াল ঘর থেকে কিছুটা দূরে স্থাপন করতে হবে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে অযথা বাইরে না ঘোরাফেরা করাই ভালো। কারণ এই সময় মাছিগুলো সব থেকে বেশি সক্রিয় থাকে।

যদি বাইরে যাওয়া খুবই প্রয়োজন হয় তবে শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই বড় হাতার শার্ট এবং প্যান্ট পড়ে শরীর পুরোটা ঢেকে বের হওয়াটাই উত্তম। বেশি সুরক্ষার জন্য জুতা মোজাও পরিধান করতে পারেন। বেলে মাছির আকার মশার থেকেও অনেক ছোট। এরা ছোট ছোট হাফ ফোকর দিয়ে যে কোন জায়গায় অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। 

তাই দরজা ও জানালায় নেট ব্যবহার করতে পারেন এবং ঘরের দেয়ালে কোন ফুটো থাকলে তা অবশ্যই বন্ধ করে দিতে পারেন। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে এবং বিছানার সাথে চারি সাইডে খুব ভালো হবে মশারি গুজে দিতে হবে। মাঝে মাঝে ঘরে চারপাশে জীবাণুনাশক ঔষধ স্প্রে করতে হবে। যেসব অঞ্চলে সংক্রমণের ঘটনা বেশি ঘটে সেইসব অঞ্চলে ভ্রমণ থেকে দূরে থাকতে হবে।

লেখকের মন্তব্য

যেহেতু শুধুমাত্র স্ত্রী জাতীয় বেলে মাছের কামড়ে এই রোগটি ছড়িয়ে থাকে, তাই অবশ্যই বাসা বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ির আশেপাশে যেন কোন ময়লার স্তুপ বা ঝোপঝাড় গড়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে।

মনে রাখবেন, কালাজ্বরে সংক্রমিত হলে ৯০% পর্যন্ত মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। তাই কালা জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং রোগ শনাক্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।এই রোগটি শনাক্ত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে কালা জ্বর থেকে নিশ্চিত মুক্তি মিলবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url